রবীন্দ্রনাথের লেখায় ফুল, ফল ও গাছপালার কথা

রবীন্দ্রনাথের উদ্ভিদপ্রীতি বিভিন্ন প্রবন্ধে, গানে, কবিতায়, ছোটগল্প, উপন্যাস ও চিঠিপত্রে স্থান পেয়েছে। বহু গাছের নামকরণ করেছেন নিজের মতো করে। লিখলেন অতনু কুমার সিংহ

প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ফুল ও গাছপালার এক মধুর অন্তর্নিহিত সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষপ্রীতি ছিল ছেলেবেলা থেকেই। ‘…দক্ষিণের বারান্দার এক কোণে আতার বিচি পুঁতিয়া রোজ জল দিতাম’ (ঘর ও বাহির, জীবনস্মৃতি, পৃঃ ১৯) ও ‘পড়ার ঘরের এক কোণে নকল পাহাড় তৈরি করে তার মাঝে ফুলগাছের চারা পোঁতা’ (জীবনস্মৃতি, পৃঃ ২০) কর্মকাণ্ডদু’টির মধ্যে ছোটবেলা থেকে তাঁর উদ্ভিদপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়।

বিভিন্ন গন্ধ ও রঙের ফুল রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল। দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার সময়  অনেক অপরিচিত গাছ নিয়ে আসতেন শান্তিনিকেতন আশ্রমে। গ্রীষ্মের জুঁই, শেফালি, মালতী বা মাধবী অথবা হলুদ রঙের সোনাঝুরি, বাসন্তী যেমন তিনি পছন্দ করতেন তেমনি রক্তকরবী, অশোক, পলাশ, শিমূল ছিল তাঁর অতি প্রিয় ফুল। নীল দিগন্তের পটভূমিতে এই সব ফুলের অপূর্ব দৃশ্য তাঁর গানে প্রকাশিত হয়েছে — ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল।’ নীল রঙের ফুলে ছিল রবীন্দ্রনাথের বিশেষ আকর্ষণ। তাঁর জন্য উইলিয়াম উইন্সটানলি পিয়ারসন আর্জেন্টিনা থেকে নীলমণিলতা এনে কোণার্ক বাড়ির সামনে রোপণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ‘বনবাণী’ কাব্যে ‘নীলমণিলতা’ নামে এক কবিতা লেখেন ও ভূমিকায় লিখেছেন — ‘নীল রঙে আমার গভীর আনন্দ তাই এই যুগের বাণী আমার যাতায়াতের পথে প্রতিদিন আমাকে ডাক দিয়ে বারে বারে স্তব্ধ করেছে…।’       

ক্যামেলিয়া, যার আদিনিবাস চিন ও জাপান, মংপুতে গৌরীদেবীর বাড়িতে প্রথম দেখাতেই অভিভূত হন এবং উজ্জ্বল ঘন সবুজ রঙের পাতা, গোলাপের মতো দেখতে এই ফুলটিকে নিয়ে ‘পুনশ্চ’ কাব্যে একটি কবিতাও লেখেন। একইভাবে আর এক বিদেশি ফুল রডড্রেনড্রন, ইউরোপ বা আমেরিকা যার আদিনিবাস, স্থান পায় তাঁর ‘শেষের কবিতা’য়। অনেক দেশি-বিদেশি ফুলের নামকরণ তিনি নিজের মতো করে করেন। যেমন – পেট্রিয়া ভলুবিলিস-এর নামকরণ করেন নীলমণিলতা, এছাড়াও ক্লেমাটিস গৌরিয়ান – তারাঝরা, সাঁওতালদের প্রিয় বনজ ফুল / লাঙ্গল ফুল (গ্লোরিওসা সুপারবা) – অগ্নিশিখা, লাথিরাস ওডোরাটাস – শ্বেতমণি সৌরভি, ঘোড়ানিম / আকাশনিম (মিলিংগ্‌টোনিয়া হরটেনসিস্‌) – হিমঝুরি, ইউফোবিয়া লিউকোসেফালা – ফুলঝুরি, একাসিয়া অরিকুলিফরমিস্‌ – সোনাঝুরি, দেশজ ফুল (প্যাভেটা ইণ্ডিকা) – বনপুলক, মধুমঞ্জরী (কুইস্‌কোয়ালিস্‌ ইণ্ডিকা) – মধুমালতী, বেগনভিলিয়া – বাগানবিলাস, রামধূনচাঁপা (ওক্‌না স্কোয়ারাসা) – বাসন্তী ইত্যাদি।   

রবীন্দ্রনাথের উদ্ভিদপ্রীতি বিভিন্ন প্রবন্ধে, বহু গানে, কবিতায়, ছোটগল্প, উপন্যাস ও চিঠিপত্রে স্থান পেয়েছে। ‘জীবনস্মৃতি’র স্মৃতিবেদনায় তিনি লিখেছেন, ‘নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ মাথায় লয়ে জট, / ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে, ওগো প্রাচীন বট।’ (ঘর ও বাহির – জীবনস্মৃতি, পৃঃ ১৫)। আবার ছিন্নপত্রাবলীতে (চিঠি সংখ্যা ১৩) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ঐ যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালবাসি – ওর এই গাছপালা, নদী, মাঠ, কোলাহল, নিস্তব্ধতা সমস্তটা সুদ্ধ দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে।’ 

‘সহজ পাঠ’এর প্রথম ভাগে রবীন্দ্রনাথ গদ্যের ভাষায় ও কবিতার ছন্দে শিশুদের প্রকৃতি সচেতন ও প্রকৃতিমনস্ক করে তোলেন। পুস্তকটির দ্বিতীয় পাঠে সাদা, রঙিন ফুলের নামের পাশাপাশি জলে ও মাটিতে জন্মানো ফুল, দিনের বিভিন্ন সময়ে ফোটা ফুলের পরিচয় দিয়েছেন। কুঁড়ি থেকে কী ভাবে ফুল ফোটে, পতঙ্গের মাধ্যমে কী ভাবে পরাগমিলন সম্পন্ন হয় ষষ্ঠ পাঠে তার ব্যাখা করেছেন।      

রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন প্রবন্ধে অনেকগুলি ফুল ও গাছপালা স্থান পেয়েছে। যেমন- বাতাবি লেবু, কুল, বিলাতি আমড়া, নারিকেল (ঘর ও বাহির – জীবনস্মৃতি), গোলাপ, শতদল পদ্ম (তথ্য ও সত্য – সাহিত্যের পথে), কুন্দ ও টগর (সৃষ্টি – সাহিত্যের পথে), শিরীষ ফুল, গোলাপ জাম, তিসি, সর্ষে (সাহিত্য ধর্ম – সাহিত্যের পথে), লঙ্কা, ডালিম (সাহিত্য তত্ত্ব – সাহিত্যের পথে), শাল, মাধবীলতা, আম, তাল, জাম, ঝাউ, নারিকেল, ছাতিম (আশ্রমের রূপ ও বিকাশ, ২ নং প্রবন্ধ) ইত্যাদি। ত্রিকোণ প্রেমের উপন্যাস ‘মালঞ্চ’তে রবীন্দ্রনাথের উদ্ভিদ প্রেম ও চেতনার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মালঞ্চ উদ্যানের পটভূমিকায় আদিত্য যেন এক মানববৃক্ষ ও সরলা তার ফুল – নীরজা আদিত্যের কাছে গুরুত্ব হারায় ও অন্যদিকে মালঞ্চের বনলক্ষ্মী হয়ে সরলা আদিত্যের জীবনে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। অন্যান্য উপন্যাসেও বহু গাছপালা স্থান পায়, যেমন – অশ্বত্থ, বাঁশ (বউঠাকুরাণীর হাট), বট, নারিকেল (চোখের বালি), শাল, গামার (রাজর্ষি), ধান, পান, কেওড়া (ঘরে বাইরে) ইত্যাদি।  

ছোটগল্পের স্বল্প পরিসর ও সীমিত বক্তব্যেও রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষপ্রেম প্রকাশিত হয়েছে। ‘গল্পগুচ্ছ’-এর ‘বলাই’তে রবীন্দ্রনাথ একজন অল্পবয়সী ছেলের বাড়ির সামনে শিমূলগাছের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। অপর এক ছোটগল্প ‘ধ্বংস’এ পিয়ের শোপাঁ ও তাঁর মেয়ে ক্যামিল যেভাবে বাগান পরিচর্যা, জোড়কলম তৈরি, ফুলের রেণু দিয়ে কৃত্রিমভাবে পরাগমিলন ঘটান তা পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথের উদ্ভিদপ্রেমের পরিচয় তুলে ধরে। তাঁর অন্যান্য ছোটগল্পেও আমরা উদ্ভিদ বৈচিত্র্য দেখতে পাই, যেমন – ‘সুভা’ গল্পে কলা, তেঁতুল, কাঁঠাল, ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে বট, ‘ঘাটের কথা’তে আম, কচু, বাবলা ফুল, শৈবাল, ‘ব্যবধান’ গল্পটিতে পাতিলেবু, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ গল্পে আম, ‘ত্যাগ’ গল্পে আম, লিচু, ‘একরাত্রি’ গল্পে সুপারি, নারকেল, মাদার, নিম ইত্যাদি। 

রবীন্দ্রনাথের অনেক কাব্যগ্রন্থের নাম উদ্ভিদজগত থেকে নেওয়া, যেমন – মহুয়া, বনবাণী, বীথিকা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের কবিতাতেও অনেক গাছপালা, যেমন – ধান (সোনার তরী – সোনার তরী), চোরকাঁটা (বীরপুরুষ – শিশু), বট (পুরোনো বট – শিশু), নারিকেল, আম (পুনর্মিলন – প্রভাতসঙ্গীত), ঝাউ (খেলা – ছবি ও গান), অশ্বত্থ (খেলা – কড়ি ও কোমল), তমাল, জাম (মেঘদূত –মানসী) ইত্যাদি। (রবীন্দ্রনাথের মালঞ্চ উপন্যাসঃ একালের প্রেক্ষিতে এবং ‘রবীন্দ্রকাব্যে ফুল’)। 

উদ্ভিদপ্রীতির পরিচয়বাহী উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আছে – রক্তকরবী, ঋণশোধ, অরূপরতন প্রভৃতি। শিলঙের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটি বাতিল লোহা দিয়ে রক্তকরবী ধ্বংস করা দেখে রক্তকরবী নাটক লেখার উৎসাহ পান। অপর এক নাটক ‘মুক্তধারা’তে দেখতে পাই রাজকুমার সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগ দিয়ে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন প্রকৃতিকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে।

চিঠিপত্রেও স্থান পেয়েছে অনেক ফুল ও ফলের গাছপালা – ভানুসিংহের পত্রাবলীর চিঠিতে প্রাচীন বট, পাকা জাম, কেয়া ফুল, নটে শাকের কথা এসেছে। এছাড়া ‘গীতবিতান’-এর পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র, আনুষ্ঠানিক সবকটি পর্যায়ের গানে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ফুল ও বৃক্ষপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়।      

এক শতাব্দীরও বেশি আগে এই মানুষটি উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতি ও পরিবেশের চিরন্তন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গাছ অপরিহার্য। ১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ দু’টি ছাতিমগাছকে কেন্দ্র করে শান্তিনিকেতনে যে নির্জন সাধনপীঠ গড়ে তুলেছিলেন তা ক্রমে রবীন্দ্রনাথের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বৃক্ষহীন জনশূন্য প্রান্তর থেকে বিশ্বের দরবারে উন্মুক্ত হয়েছে। পুত্র রথীন্দ্রনাথ, বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদার ও জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা থেকে কৃষিবিদ্যায় স্নাতক হয়ে ফিরে এলে শ্রীনিকেতনে কৃষি ও পল্লিপুনর্গঠনে তাঁদের সামিল করার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের রুক্ষ জমিকে শ্যামল করে তোলার কাজে সচেষ্ট হন। শান্তিনিকেতনে ‘বর্ষামঙ্গল’ (১৯২২), ‘বৃক্ষরোপণ’ (২১ জুলাই ১৯২৮) এবং ‘হলকর্ষণ’ (২২ জুলাই ১৯২৮) উৎসবের সূচনা করেন। রথীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের পরিকল্পনায় উত্তরায়ণে ইসলামিক (মোগল), জাপানী স্থাপত্যের অনুকরণে উদ্যান রচিত হয়। আজও উত্তরায়ণে পারিজাত, পালতে মাদার, রুদ্র পলাশ, জ্যাকারাণ্ডা, ম্যাগনোলিয়া, প্যাসচিরা, পান্থপাদপ প্রভৃতি দুর্লভ গাছপালার সমাবেশ লক্ষণীয়। ‘বকুলবীথি’, ‘শালবীথি’, ‘মাধবীবিতান’ – একের পর এক রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মধ্যে স্থান নেয়। গাছের ছায়ায় পঠনপাঠন অবচেতনভাবেই ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃতি ও গাছকে ভালবাসতে শেখায় ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশের পথ সুগম করে। উদ্ভিদের শ্যামলিমার মত চিরনতুন রাখতে এবং উদ্ভিদজগতের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা স্মরণ রেখে বিশ্বভারতী থেকে সদ্য স্কুল সার্টিফিকেট (মাধ্যমিক), প্রি-ডিগ্রি (উচ্চ-মাধ্যমিক), স্নাতক, স্নাতকোত্তর পরীক্ষা, গবেষণায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের এবং ‘দেশিকোত্তম’, ‘অবন-গগন’ ও ‘রথীন্দ্র পুরস্কার’ প্রাপকদের হাতে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাতিমপাতার (সপ্তপর্ণী) অভিজ্ঞান একমাত্র বিশ্বভারতীতেই তুলে দেওয়া হয়। 

লেখক বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারের কর্মী, মতামত নিজস্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *