বৃক্ষাচার্য ও নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা
তার পরিচয় বৃক্ষাচার্য, জীববিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক, অনুবাদক ও উদ্ভিদ গবেষক কিংবা নিসর্গসখা। তিনি অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। বাংলাদেশে গাছগাছালি তথা উদ্ভিদজগত নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কাজ চালিয়ে গেছেন আমৃত্যু। তার একটা বিখ্যাত উক্তি হলো,‘জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলন আমাদের দেশে আছে, জোরেশোরেই আছে, তবে প্রাণিজগতের দিকে পক্ষপাত অধিক, উদ্ভিদজগৎ অপেক্ষাকৃত অবহেলিত। বন রক্ষা বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, তবে একক প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকানো আর বনরক্ষা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রথমটির জন্য প্রয়োজন প্রতিটি বিপন্ন প্রজাতি বাঁচানোর দায়িত্ববোধ ও প্রকৃতিপ্রেম। এখানে ভালোবাসা মুখ্য, বৈষয়িকতা গৌণ, যা আমাদের মনে আজও তেমন নিবিড় ও গভীর নয় ।’
মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড়ের কোলে শিমুলিয়া গ্রামে ১৯২৯ সালের ২৯ মে জন্ম মানুষটির। প্রকৃতি ও গাছগাছালির প্রতি ভালোবাসা ও লেখালেখির কারণে তিনি বিখ্যাত। প্রকৃতি নিয়ে তার আজীবনের ভালবাসার কারণেই দ্বিজেন শর্মাকে ‘নিসর্গসখা’ বলা হয়।তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন বাংলাদেশে প্রকৃতি ও নিসর্গবিষয়ক লেখালেখিকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে। ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভোরে ৮৮ বছর বয়সে ঢাকার এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
তাঁর বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা ছিলেন ওই অঞ্চলের বিখ্যাত কবিরাজ। তার বাবার ছিল অনেক ফুলগাছ, আম-কাঁঠালের গাছ আর বনৌষধি। সঙ্গত কারণেই উদ্ভিদের প্রতি দ্বিজেন শর্মার ভালবাসা পিতার কাছ থেকেই পাওয়া। মাঝে মাঝে ছুটে যেতেন গহিন জংগলে। দ্বিজেন শর্মার মুল প্রেরণা ছিলো দেশের সর্ব বৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুণ্ডের উৎস পাথারিয়া পাহাড়। তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবনে পৃথিবীর বহু প্রকৃতাঞ্চলে পরিভ্রমণ ও সময় কাটালেও আমৃত্যু হৃদয়ে দোলা দিতো শৈশব স্মৃতির ঘন বনাঞ্চল পাথারিয়া।
বৃক্ষসখা দ্বিজেন দ্বিজেন শর্মার পড়াশোনা শুরু হয় শিমুলিয়া গ্রামের পাঠশালায়। আসামের করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুল থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন তিনি।উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন করিমগঞ্জ কলেজ, বিএম কলেজ ও নটরডেম কলেজে। পরে মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে চাকরি করেছেন প্রায় ২০ বছর। এরপর দেশে ফিরে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে। শত ব্যস্ততার মাঝে দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ রাজধানীতে অসংখ্য জায়গায় গাছ লাগিয়েছেন নিজ হাতে। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য লড়াইও করেছেন অন্যদের নিয়ে।
উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে তাঁর প্রথম ও বিখ্যাত গ্রন্থ ‘শ্যামলী নিসর্গ’ লেখেন। এছাড়াও গাছ, ফুল বা ফলের বর্ণনায় লিখেছেন ময়মনসিংহ গীতিকা, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীনের কাব্য থেকে শুরু করে সিলেটের লোকগীতি, কিংবা মধ্যযুগের কাব্যগাথার উদ্ধৃতি।তাঁর অন্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে-‘সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস’, ‘ফুলগুলি যেন কথা’, ‘গাছের কথা ফুলের কথা’, ‘এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি’, ‘নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা’, ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘জীবনের শেষ নেই’, ‘বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ’, ‘ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি’, ‘বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা’, ‘গহন কোন বনের ধারে’, ‘হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার’, ‘বাংলার বৃক্ষ’ ইত্যাদি।
এসব কীর্তির জন্য অবশ্য দ্বিজেন শর্মা ২০১৫ সালে একুশে পদক, ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র পদক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন পরিবেশ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।